ভূমিকা
ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী এবং জনগণের প্রিয় রাষ্ট্রপতি Dr. A. P. J. Abdul Kalam এমন একজন মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবে রূপান্তরের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী বা প্রশাসক নন, ছিলেন আদর্শবাদী চিন্তক, শিক্ষক এবং এক মহান মানবতাবাদী। তরুণ প্রজন্মের জন্য তাঁর শিক্ষা, আদর্শ এবং জীবনদর্শন আজও এক অমলিন প্রেরণার উৎস। এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি জীবন, উক্তি, সাহিত্য ও সম্মাননার বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব।
১. শৈশব ও শিক্ষা :(Dr. A. P. J. Abdul Kalam)
ড. কালামের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম নামক এক ছোট দ্বীপ শহরে। তাঁর পরিবার ছিল একেবারে সাধারণ; পিতা জয়নুলাবেদিন ছিলেন নৌকা নির্মাতা এবং মা আশিয়াম্মা ছিলেন এক আদর্শ গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই আবদুল কালাম ছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমী, মিতভাষী এবং অধ্যবসায়ী।
অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি সংবাদপত্র বিলি করতেন, যাতে পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রামেশ্বরমের স্থানীয় স্কুলে হয়। পরে তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন।
এরপর চেন্নাইয়ের বিখ্যাত Madras Institute of Technology (MIT)-তে ভর্তি হন, যেখানে তিনি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। এখানেই তাঁর জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে এসেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তাঁর জীবন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দেশের উন্নয়নে উৎসর্গ করবেন।
MIT-তে পড়ার সময় তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং স্বপ্ন দেখে যাওয়ার মানসিকতা আরও সুদৃঢ় হয়। এই সময়ই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি এবং উদ্ভাবনী মনোভাব গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে ভারতের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে বহুদূর এগিয়ে দেয়।

২. বৈজ্ঞানিক জীবন:(Dr. A. P. J. Abdul Kalam)
ড. কালামের বিজ্ঞানজীবন শুরু হয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO)-তে। এরপর তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)-তে কাজ শুরু করেন, যেখানে তিনি ভারতের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যানের (SLV-III) সফল উৎক্ষেপণে নেতৃত্ব দেন।
এছাড়া তিনি ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিকে আত্মনির্ভর করে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ‘Agni’, ‘Prithvi’, ‘Akash’, ‘Nag’ ইত্যাদি অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়, যার ফলে তাঁকে ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়।
১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন—“একটি শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভর জাতি গড়তে হলে বিজ্ঞানে বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবন অপরিহার্য।” তাঁর চিন্তাভাবনা ও কাজের মাধ্যমেই ভারত বিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছায়।
৩. রাষ্ট্রপতি জীবন(Dr. A. P. J. Abdul Kalam)
২০০২ সালে ড. কালাম ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ভারতের প্রথম বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রপতি ছিলেন, এবং তাঁকে ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ বলা হতো, কারণ তিনি সাধারণ মানুষের কাছে সর্বদা সহজে পৌঁছাতে পারতেন।
তাঁর রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদকালে তিনি শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং যুব সমাজের ক্ষমতায়নে মনোনিবেশ করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনকে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন, যাতে তারা তাঁর থেকে শিখতে পারে। তরুণদের জন্য তিনি ছিলেন এক জীবন্ত প্রেরণা। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতির ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতেই নিহিত এবং সঠিক দিশা পেলে তারা অসাধ্যকে সাধন করতে পারে।
তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না, এবং তাঁর কাজ ও বক্তব্য সর্বদাই জাতীয় স্বার্থে নিবেদিত ছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ ছিল শান্ত, প্রগতিশীল এবং তরুণ-উন্মুখ। তিনি প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের জন্য একটি স্বপ্নময়, আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যমী ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।
৪. সাহিত্য ও প্রেরণার গ্রন্থগুলি:(Dr. A. P. J. Abdul Kalam)
ড. কালাম ছিলেন একজন দক্ষ লেখক এবং চিন্তক। তাঁর লেখা বইগুলিতে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বা উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের সম্ভাবনা, আত্মশক্তি ও দেশপ্রেমের কথা উঠে এসেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় বই “Wings of Fire”—একটি আত্মজীবনী যা তাঁর সংগ্রামী জীবনের নিখুঁত দলিল।
“Ignited Minds”, “India 2020”, “My Journey”, “Transcendence”—এই বইগুলোতে তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ, তরুণদের ক্ষমতা, আধ্যাত্মিকতা এবং প্রযুক্তির গুরুত্ব নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন।
তাঁর লেখায় দেখা যায় বাস্তবতা, স্বপ্ন, যুক্তি ও আত্মবিশ্বাসের এক অপূর্ব সমন্বয়। তাঁর বইগুলো স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিক্ষার্থী, গবেষক ও ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য এসব বই শুধুই প্রেরণা নয়, বরং জীবনের দিশারিও বটে।
৫. ড. কালামের জনপ্রিয় উক্তিসমূহ
“If you fail, never give up because FAIL means First Attempt In Learning.”
এই কথার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন যে ব্যর্থতা কখনও শেষ নয়, বরং শিখে ওঠার একটি সূচনা মাত্র।
“Dream is not that which you see while sleeping, it is something that does not let you sleep.”
স্বপ্ন এমন কিছু নয় যা ঘুমের মধ্যে আসে, বরং এমন এক লক্ষ্য যা তোমার ঘুম কেড়ে নেয় যতক্ষণ না তা পূরণ হয়।
“You have to dream before your dreams can come true.”
বাস্তবতা গঠনের জন্য আগে মনের ভেতরে সেই ছবি আঁকতে হয়—স্বপ্ন দেখাই হলো শুরু।
“Great dreams of great dreamers are always transcended.”
যারা সত্যিই বড় স্বপ্ন দেখে, তারা একদিন না একদিন সেই স্বপ্নকেই ছাড়িয়ে যায়।
“Excellence happens not by accident. It is a process.”
শ্রেষ্ঠত্ব একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও অধ্যবসায়ের ফল; এটি সময় নিয়ে গড়ে ওঠে।
ড. কালামের এই উক্তিগুলি শুধুই উদ্ধৃতি নয়—এইসব বার্তায় নিহিত রয়েছে আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং দেশপ্রেমের অমোঘ শক্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি কেউ নিজের ভেতরের শক্তি এবং সম্ভাবনাকে চিনে নিতে পারে, তাহলে তার জন্য কোনও সীমানাই অসম্ভব নয়।
৬. পুরস্কার ও সম্মাননা
ড. কালামের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে বহু পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৮১ সালে Padma Bhushan, ১৯৯০ সালে Padma Vibhushan, এবং ১৯৯৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান Bharat Ratna লাভ করেন।
এই পুরস্কারগুলো শুধু তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের জন্যই নয়, বরং তাঁর মানবিকতা, শিক্ষা ও রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্যও দেওয়া হয়। ২০১০ সালে জাতিসংঘ তাঁর জন্মদিন ১৫ অক্টোবর-কে “World Students’ Day” হিসেবে ঘোষণা করে।
তাঁর সম্মানে ভারতের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে চেয়ার, ফেলোশিপ, স্মারক মূর্তি ও পাঠ্যকোর্স চালু হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই, শিলং-এর IIM-এ বক্তৃতা দেওয়ার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবরে সমগ্র জাতি শোকাহত হয়, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, দর্শন ও স্বপ্ন আজও কোটি মানুষের অন্তরে জয়ন্ত।

উপসংহার:
ড. এ. পি. জে. আবদুল কালাম কেবল একজন রাষ্ট্রনায়ক নন, বরং এক স্বপ্ন ও কর্মের নাম। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—স্বপ্ন দেখতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে এবং কখনো হাল ছাড়লে চলবে না। তাঁর জীবন এক জীবন্ত পাঠশালা, যা আজও মানুষকে আত্মশক্তি, প্রেরণা এবং দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। তিনি ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন—প্রত্যেক ভারতীয়ের হৃদয়ে চিরন্তন এক আলো।