উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ১০টি কার্যকর ঘরোয়া উপায় — স্বাভাবিক রাখুন আপনার রক্তচাপ, ওষুধ ছাড়াও

বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার (Hypertension) একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে না আনলে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি সমস্যা সহ বিভিন্ন জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। যদিও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ জরুরি হতে পারে, তবে কিছু ঘরোয়া উপায় মেনে চললে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চলুন জেনে নিই এমন ১০টি ঘরোয়া টিপস যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

১. প্রতিদিন রসুন খান

রসুনে থাকা অ্যালিসিন নামক প্রাকৃতিক যৌগটি রক্তনালিকে প্রসারিত করে, ফলে রক্ত প্রবাহ সহজ হয় এবং রক্তচাপ কমে আসে। এটি রক্তের মধ্যে নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন বাড়ায়, যা রক্তনালিকে শিথিল করে এবং রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। খালি পেটে ১–২ কোয়া কাঁচা রসুন প্রতিদিন সকালে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী। অনেকে কুচি করে মধু মিশিয়ে খেয়ে থাকেন — এটিও কার্যকর। তবে রসুন খাওয়ার পরে মুখের গন্ধ দূর করতে লবঙ্গ বা মৌরি চিবানো যেতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ

২. কম লবণ খান

অতিরিক্ত সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ। লবণ শরীরের পানি ধরে রাখে এবং রক্তনালিতে চাপ সৃষ্টি করে। তাই প্রতিদিনের খাবারে অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলুন। রান্নায় হিমালয়ান পিংক সল্ট বা লো-সোডিয়াম সল্ট ব্যবহার করুন। রেস্তোরাঁর খাবার, প্যাকেটজাত খাবার এবং ফাস্ট ফুডে অতিরিক্ত লবণ থাকে — সেগুলিও কমিয়ে দিন। খাবারের স্বাদ বাড়াতে লেবুর রস, ভিনেগার বা মশলার ব্যবহার করুন।

৩. শারীরিক ব্যায়াম করুন

নিয়মিত ব্যায়াম রক্তনালিকে নমনীয় করে এবং হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বাড়ায়, যা রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হেঁটে নিন, দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং, জগিং অথবা সাঁতার খুবই উপকারী। যোগাসন, যেমন ‘ভুজঙ্গাসন’ বা ‘শবাসন’, মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। আপনি যদি অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন, তাহলে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ৫ মিনিট হেঁটে নেওয়া দরকার। ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।

৪. ধ্যান ও প্রাণায়াম অভ্যাস করুন

মেডিটেশন বা ধ্যান আমাদের মনের অবচেতন স্তরকে শান্ত করে তোলে, যা মানসিক চাপ কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রতিদিন সকালে ১০–১৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে নিরিবিলি পরিবেশে বসুন এবং মনকে শিথিল করুন। প্রাণায়ামের মধ্যে “অনুলোম-বিলোম” ও “ভ্রমরী” অত্যন্ত কার্যকর। এগুলো স্নায়ুতন্ত্রকে প্রশান্ত করে এবং হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে দু’বার এই অভ্যাস করলে ফল আরও ভালো হবে।

উচ্চ রক্তচাপ

৫. কলা খান নিয়মিত

কলায় প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম নির্গত করতে সাহায্য করে। এটি রক্তচাপ কমানোর একটি প্রাকৃতিক উপায়। প্রতিদিন ১–২টি পাকা কলা খেলে শুধু রক্তচাপই নয়, হজম প্রক্রিয়া ও শক্তি বজায় রাখতেও সহায়তা করে। যারা ডায়াবেটিক, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কলার পরিমাণ ঠিক করুন। এছাড়া পটাশিয়ামযুক্ত অন্য ফল যেমন অ্যাভোকাডো, আঙুর, কমলা, তরমুজ ইত্যাদিও উপকারী।

উচ্চ রক্তচাপ

৬. চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন

অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। কোল্ড ড্রিংকস, মিষ্টি পানীয়, মিষ্টি দই, চকোলেট, কেক– এসব খাওয়া কমিয়ে দিন। বিকল্প হিসাবে মধু, খেজুর বা ফলের প্রাকৃতিক মিষ্টতা গ্রহণ করতে পারেন। তবে ডায়াবেটিক রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। লেবু জল বা দারচিনি পানি শরীরকে সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে।

৭. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

বেশি ওজন বা স্থূলতা রক্তচাপ বাড়ার অন্যতম কারণ। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি থাকলে হৃদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ওজন কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাদ্যাভ্যাস (কম ক্যালোরি, বেশি আঁশযুক্ত খাবার), নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান ও ঘুম — এই চারটি অভ্যাস আপনাকে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। BMI (Body Mass Index) ঠিক রাখতে চেষ্টা করুন ১৮.৫ থেকে ২৪.৯-এর মধ্যে।

উচ্চ রক্তচাপ

৮. ক্যাফেইন গ্রহণ কমান

ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা, কফি বা এনার্জি ড্রিংক সাময়িকভাবে হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে রক্তচাপ বাড়াতে পারে। দিনে ১–২ কাপের বেশি কফি না খাওয়াই ভালো। যাদের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের জন্য ক্যাফেইন আরও ক্ষতিকর হতে পারে। বিকল্প হিসাবে হার্বাল টি (যেমন তুলসী, দারচিনি, মেথি চা) খাওয়া যেতে পারে। এনার্জি ড্রিংক, সফট ড্রিংক ও কোল্ড কফি এড়িয়ে চলুন।

৯. পর্যাপ্ত ঘুম দিন

ঘুমের অভাব মানসিক চাপ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং স্নায়ুতন্ত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করে — যা রক্তচাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম জরুরি। ঘুমানোর আগে মোবাইল বা টিভি স্ক্রিন এড়িয়ে চলুন, হালকা আলো ও শান্ত পরিবেশ তৈরি করুন। রাতে এক সময়ে শোয়া ও সকালে একই সময়ে ওঠার অভ্যাস করুন। দুপুরে ঘুম এড়িয়ে চললে রাতের ঘুম আরও উন্নত হয়।

উচ্চ রক্তচাপ

১০. দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকুন

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ আমাদের দেহে কর্টিসল ও অ্যাড্রিনালিন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। হালকা গান শুনুন, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন বা নিজের পছন্দের কোনো শখে মন দিন। নিজের সময় বের করা ও নিজেকে ভালোবাসা — এগুলোই মানসিক সুস্থতার মূল চাবিকাঠি।

অতিরিক্ত পরামর্শ:

  • ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
  • খাদ্যতালিকায় সবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার রাখুন।
  • নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।

উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক, তবে নিয়মিত জীবনযাপন ও ঘরোয়া নিয়ম মেনে চললে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ওষুধের পাশাপাশি এই প্রাকৃতিক উপায়গুলি অনুসরণ করলে সুস্থ ও নিরাপদ জীবন যাপন করা যাবে। আপনার পরিবার বা পরিচিত কেউ উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে, এই তথ্য শেয়ার করতে ভুলবেন না।

Read More…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top